বিস্মরণ বিস্মরণ বিস্মরণ!!!

Source: Internet

মাত্র খবরগুলো পড়লাম। প্রচন্ড ক্ষোভ হল! ক্ষোভের ঘটনা বলার আগে একটি মজার ঘটনা বলি।

একবার বন্ধুরা মিলে ভারতবর্ষে গিয়েছি। বন্ধুদের মধ্যে একজনের নাম ছিল রফিক। তার একটি বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য ছিল. সে বিপদের সময় সবকিছু ভুলে যেত, এটা তো সবাই যায়, কিন্তু ওর ব্যাপারটি একটু মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে। কয়েকজন তাকে “বিস্মরিত রফিক” বলেও ডাকত! একবার আমরা সবাই মিলে গাড়ি ভাড়া করে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছি। পথে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে কি একটা সমস্যা হয়েছিল। পরিস্থিতি নিয়স্ত্রণে আনার জন্য পুলিশের বিশাল দলবল এসে হাজির। পুলিশ এক একটি গাড়ি আটকাচ্ছে আর সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এমনিতেই ভীনদেশী! ভয়ে বুক এমনিতেই এক হাত চুপসে আছে। আল্লাহ-ভগবানের নাম জপা শুরু করে দিয়েছি। যথারীতি পুলিশ আমাদের গাড়িও আটকালো, একে একে সবার পাসপোর্ট চেক করল আর টুকটাক জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। সবারটা শেষ করে রফিকের পালা। তার পাসপোর্টটি ওরা হাতে নিল! তার নাম জিজ্ঞেস করল। যা হওয়া তাই হল! নিয়মমাফিক সে কিছুতেই তার নাম মনে করতে পারছে না। সবার মাথায় হাত! সে যদি গড়বড় পাকিয়ে ফেলে? দেশে পৌছতে পারব তো? আমরা সবাই মিলে তাকে চিমটি কাটি, গুতো দেই। কিন্তু বিধিবাম, তার পরিস্থিতির কোন উত্তোরণ নেই। হা করে তাকিয়ে আছে! মুখ চুপসে আছে!! তার প্যান্টের দিকে আড়চোখে তাকাই, জলবিয়োগ জাতীয় কোন কেলেঙ্কারী করে দিবে নাতো! পরে আমরা হাল ছেড়ে দিয়ে আমরাই তার নামটি বলে দেই এবং পরিস্থিতি পুলিশদলকে বুঝিয়ে বলি। দয়াপরবশ হয়ে পুলিশ আমাদের এ যাত্রা রক্ষা করেছিল। এ কাহিনী টেনে আনার কারন হল, আমরা জাতিগতভাবে রফিকের মতই। আমরাও কোন এক কারনে বেশিরভাগ উল্লেখযোগ্য ঘটনাই ভুলে যাই। বিস্মরিত নাগরিক বললে ভুল হবে না।

কদিন আগে তারেক মাসুদ, মুশীক মুনিরের করুণ মৃত্যু হল। আমরা মাঠ গরম করে দিলাম। ভয়াবহ কিছু ঘটে গেলে আমরা জুকারবার্গের ফেসবুক ডাটাবেজ পোস্টে পোস্টে ভরিয়ে ফেলতে জানি, কয়েকটি মাউসের গুতায় ফেসবুকের আঙ্গিনা বাংলায় গালি দিয়ে উজাড় করে ফেলত পারি। দুই মাইল দুরে গিয়ে তো আর পোস্ট দেওয়ার ব্যাপার-স্যাপার নেই। নিরিবিলি পোস্ট শেয়ার করেই আমাদের তৃপ্তি! বোনাস হিসেবে দেশউদ্ধারের দায়মুক্তির অনূভতি। মাঠে নামতেই শুধূ আমাদের যত অনীহা! ইশতেহার দেনেওয়ালারাই তো নেতৃত্তের গদি পায়, তাহলে কি দরকার মাঠে-চড়া বিপ্লবী হওয়ার!! কদিন পর যথারীতি আমরা সব ভুলে গেলাম। আজ শুনলাম আরও দুটি ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার কথা (সূত্র: ১,২)। বেশ কয়েকজন রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। এই ব্যাপারটি আমাকে চরম নাড়া দিয়েছে। এই ঘটনাটাই আজকের এই  অস্বাভাবিক ক্ষোভ প্রকাশ করতে বাধ্য করেছে আমাকে। বস্তুত, এই মৃত্যুগুলোর জন্য কি আমরাও দায়ী হযে পড়ছি না??? আমরাও কি নীরব সায় দিচ্ছি না প্রতিনিয়ত??? একটার পর একটা সড়ক দুঘর্টনা ঘটছে প্রতিদিন যা একটু সরকারী সদ্দিচ্ছা এবং মানব সচেতনতাই অনেক কমিয়ে দিতে পারে!! মানবজমিনের একটি খবরে (সূত্র: ৩) জানিতে পারি, পৃথিবীতে আমাদের দেশেই সড়ক দূঘটনা সবচেয়ে বেশি হয়!!! বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৫০ জন মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়।  আমরা কি অতীতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা কদিন পরেই ভুলে যাই? দূঘটনাগুলো থেকে কি কিছুটা উত্তোরণ গটাতে পারি না?? একদিন যদি আমিও এভাবে মরে যাই, ফেসবুকে কয়েকটি স্ট্যাটাস দিয়ে কদিন পরেই কি সবাই ভুলে যাবে? আমরা ৭১ এ যুদ্ধাপরাধীদের কর্মকান্ড ভুলে যাই। তাদেরকে আবার আযোজন করে জাতীয় সংসদে পাঠিয়ে দেই। ক্রিকেট হেরে গেলে পাকিস্তানের জন্য অবিরাম চোখের জল ফেলি, জিতে গেলে মাইক ভাড়া করে আনন্দ-মিছিল বের করি!!। এভাবেই আমাদের ভাই-বোনের রক্ত-স্মৃতি ভুলে যেতে পারি কি?

এই দুই মেধার করুণ মৃত্যুকে “দুর্ঘটনা” বলে আখ্যায়িত করে সরকার। একার্থে এটাকে পরিশেষে শান্তচিত্তেই মেনে নিল সবাই। নাগরিকদের জন্য নিরাপদ চলাচলব্যবস্থা গড়ে তোলায় রাষ্ট্রের নিদারুণ ব্যর্থতার পরিণাম “রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড”, এটা তো দুর্ঘটনা নয়! যা এড়ানো সম্ভব তা “দুর্ঘটনা” বলে কখনই মেনে নেওয়া যায় না। দেশের বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী এই তথাকথিত দুর্ঘটনার জন্য শোক প্রকাশ করলেন। তাদের তো প্রয়োজন ছিল লজ্জিত হওয়ার! এই দুই দেশপ্রেমিককে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার জন্য সমগ্র জাতির কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করার! তারা তো করেননি! এসবও আমরা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাই। আবারও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলে প্রতিদিন।

কোথায় যেন পড়েছিলাম, জেলী ফিশের একটি বিশেষ ধর্ম হল, কয়েক মুহূর্ত আগে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা মনে রাখতে না পারা। স্বাভাবিক মস্তিস্কের সকল উপাদান থাকা সত্ত্বেও জীববিজ্ঞানীদের কাছে এর কারন এখনও অনুদঘাটিত। আমরাও কি জেলী ফিশের চেয়ে বেশি কিছু??

কদিন আগের ঘটনা! অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার একটি ছোট্ট রাস্তা দিয়ে হাটছি! রাস্তায় এক অস্ট্রিায়ার নাগরিকের সাথে পরিচয় হয়। কথাপ্রসঙ্গে উনি বাংলাদেশের নেগেটিভ দিকগুলোই টেনে আনছিল তখন, যা হয় আরকি। আমি এমনিতে কোন কিছুতে রাগী না, কিন্তু আমার আতে ঘা লাগে এমন কোন ঘটনা ভীনদেশি বলে গেলে তাকেও আমি ছেড়ে কথা কই না!! ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি রীতিমত ক্ষুব্ধ। অতিরিক্ত ভরা বাতাসে ফেটে যাওয়া বেলুনের মত তীব্রবেগে বলি, আমরা ত্রিশলাখ মানুষের রক্ত দিয়ে একটি পতাকা বানাই, তাজা তরুণদের লাশ দিয়ে একটি শহীদ মিনার গড়ি, হাজার হাজার মায়েদের সম্ভ্রম দিয়ে একটি স্মৃতিসৌধ বানাই, সারাদিন একবেলা খেয়েও প্রিয় মানুষদের সাথে নিয়ে ভালবাসার স্বর্গ করি! এরকম ইতিহাস আছে কজনার? লোকটি কিছুটা মিইয়ে গিয়েছিল তখন! তারপর মনে মনে বলি, আমরা সবই পারি, সবই করি! শুধু মাঝে মাঝেই ভুলে যাই। অনেক বড় বড় ঘটনাই ভুলে যাই!! আমরা কি শুধুই এমনি এমনি ভুলে যাই, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবেই কাজটা করি!

পাদটীকা: জার্মানীর বিখ্যাত লেখক রিচার্ড রেমেল এর একটি বইতে পড়েছিলাম, মানবজাতি সেটাই মনে রাখে যেখানে তার গোপন অভিলাষ থাকে। তবে তারা যা ভুলে যেতে চায়, তা নিয়ে তাদের ক্ষনিকের উচ্ছাস চোখে পড়ার মত! সত্যি কি তাই!

সুত্র:

১. http://www.prothom-alo.com/detail/news/200306

২. http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-11-12/news/200325

৩. http://www.mzamin.com/index.php?option=com_content&view=article&id=16782:2011-08-13-16-27-05&catid=48:2010-08-31-09-43-22&Itemid=82

Leave a Reply